যে দেশের এক শহরে ক্রিকেট নিষিদ্ধ, সেই দেশই এখন টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে

যে দেশের এক শহরে ক্রিকেট নিষিদ্ধ, সেই দেশই এখন টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে

২০২৬ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে ফুটবল–পাগল দেশ ইতালি। ক্রিকেট সেখানে কীভাবে শুরু হলো, কতটা পথ পেরিয়ে ইতালি এই পর্যায়ে উঠে এল সেই গল্পটা জেনে নিতে পারেন।

ইতালি জাতীয় ক্রিকেট দলআইসিসি

২০২৬ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে ইতালি—এই খবর শুনে কারও কারও মনে সবার আগে অন্য এক প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে; ইতালিও তাহলে ক্রিকেট খেলে!

আসলে ইতালি ফুটবল-পাগল দেশ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তা সবারই জানা। চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তাঁদের শীর্ষ ফুটবল লিগ সিরি আ বিশ্বের অন্যতম সেরা। ইতালিয়ান ফুটবলের ঐতিহ্য, সাফল্য এবং তাদের কিংবদন্তিদের তালিকার সঙ্গে খুব কম দেশেরই তুলনা চলে। আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর হালহকিকত সেভাবে জানা না থাকলে তাই ইতালির ক্রিকেট খেলার কথা শুনে বিস্মিত হওয়াটা খুব দোষের নয়। কেউ কেউ রসিকতা করে এখন বলতে পারেন, ইংল্যান্ডের পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ফুটবল বিশ্বকাপ ও ক্রিকেটের বিশ্বকাপ জয়ের সুযোগ এখন ইতালির সামনে!

২০২৬ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিশ্চিত হলো কোন কোন দেশের

এখনই এমন আশা অবশ্যই বাড়াবাড়ি। আইসিসি টি–টোয়েন্টি র‌্যাঙ্কিংয়ে দেশগুলোর মধ্যে চার ধাপ এগিয়ে ২৮তম স্থানে উঠে এসেছে ইতালি। মোট ৯৬টি সহযোগী দেশের মধ্যে এই অবস্থান অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। সেটা যেমন ভালো খবর, তেমনি টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম খেলার সুযোগ পাওয়া নিশ্চিতভাবেই ইতালিতে ক্রিকেটের জোয়ার তৈরি করবে কচিকাঁচাদের মধ্যে। তবে এই ইতালিতেই কিন্তু গত বছর একটি শহরে ক্রিকেট খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

আদ্রিয়াটিক সাগরের উপকূলঘেঁষা মনফালকোনে শহরে ক্রিকেট নিষিদ্ধ করেছিলেন সেখানকার মেয়র। তখন বিবিসির প্রতিবেদনে জানা গিয়েছিল, মনফালকোনে শহরে ৩০ হাজারের কিছু বেশি মানুষের বসবাস। এর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বিদেশি এবং তাঁদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি মুসলিম। মনফালকোনের শহরের বাইরে ক্রিকেট খেলা একটি দলের অধিনায়ক মিয়া বাপ্পি তখন বিবিসিকে জানান, শহর কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলেছেন, ‘ক্রিকেট ইতালির জন্য নয়।’

মনফালকোনে শহরের ভেতরে ক্রিকেট খেললে সর্বোচ্চ ১০০ ইউরো জরিমানা করা হয়। এই শহরের মেয়র আন্না মারিয়া চিসিন্ত ক্রিকেট নিষিদ্ধ করার কারণ জানতে চাইলে বিবিসিকে চিসিন্ত বলেছিলেন, নতুন একটি পিচ (ক্রিকেট খেলার জন্য) তৈরি করার মতো জায়গা বা অর্থ নেই। ক্রিকেট বলকেও তিনি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন। এই মেয়র তখন আরও বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশিদের তাদের প্রিয় খেলা ক্রিকেট খেলতে দিতে চান না, ‘তারা এ শহরকে কিছু দেয় না, আমাদের জনগোষ্ঠীকে কিছু দেয় না। ফল শূন্য।’

গোটা ইতালি বিচারে এটিকে কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্তও ভাবতেও পারেন। কারণ, ইতালিতে ক্রিকেটের শিকড় পোঁতা বহু বছর আগে। ফুটবলের মতো খেলাটি ডালপালা গজিয়ে মহিরুহ আকার ধারণ করেনি ঠিকই, তবে দেরিতে হলেও এগোচ্ছে ইতালিয়ান ক্রিকেট। ৫ জুলাই বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইতালিতে এখন ১০০টির বেশি ক্রিকেট ক্লাব রয়েছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্রিকেটারের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের বেশি।

তবে এ সংখ্যাটা ক্ষুদ্র মনে হতে পারে ইতালিতে প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ খেলার সময়টা শুনলে—সর্বকালের অন্যতম সেরা নৌ কমান্ডার ব্রিটেনের লর্ড হোরাশিও নেলসনের নৌবহর থেকে নাবিকেরা নেমে ১৭৯৩ সালে নেপলসে প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছিলেন। অর্থাৎ ক্রিকেটের শিকড় পোঁতার ২৩২ বছর পর খেলাটির শীর্ষ পর্যায়ের এক আসরে নাম লেখাল ইতালি। ফুটবলের জনপ্রিয়তার সঙ্গে দেশটিতে ক্রিকেটের কোনো তুলনা চলে না ঠিকই, কিন্তু একটি জায়গা ইতালি জাতীয় ফুটবল দল ও জাতীয় ক্রিকেট দল সমান—নীল জার্সির দুই দলকেই ‘আজ্জুরি’ নামে ডাকা হয়।

টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জায়গা পাওয়ার পর ইতালির খেলোয়াড়দের উদ্‌যাপন
টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জায়গা পাওয়ার পর ইতালির খেলোয়াড়দের উদ্‌যাপনআইসিসি এক্স হ্যান্ডল

ইতালিয়ান ক্রিকেট ফেডারেশনের সাবেক চেয়ারম্যান সিমোন গাম্বিনো তাঁর বইয়ে ইতালিতে ক্রিকেটের পথচলার গল্প বলেছেন। তাঁর বই অনুযায়ী, ব্রিটিশরা ক্রিকেটকে ইতালিয়ানদের কাছে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার পর আঠারো শতকের শেষ দিকে ও উনিশ শতকের শুরুতে সেখানকার অভিজাতদের মধ্যে খেলাটি জনপ্রিয়তা পায়। ৯ বারের ইতালিয়ান শীর্ষ লিগ চ্যাম্পিয়ন জেনোয়া এফসি দেশটিতে বর্তমানে যত ফুটবল ক্লাব আছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো। ১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে এ ক্লাবটি যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন নাম ছিল জেনোয়া ক্রিকেট অ্যান্ড অ্যাথলেটিক ক্লাব। ব্রিটিশ কিছু অভিবাসী এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে ফুটবল প্রধান খেলা ছিল না।

ইতালির আরেকটি বিশ্বখ্যাত ক্লাবের উদাহরণ টানা যায়। ১৯ বার সিরি আ ও ৭ বারের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন এসি মিলান। ১৮৯৯ সালে এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রিটিশ অভিবাসী হাবার্ট কিলপিন। তখন এর নাম ছিল মিলান ফুট–বল অ্যান্ড ক্রিকেট ক্লাব। তবে জেনোয়া ও এসি মিলানের আগেও ইতালিতে একটি ক্রিকেট ক্লাব ছিল—রোম ক্রিকেট ক্লাব। ১৮২০ সালে এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিছু ধনী ব্রিটিশ ও ক্রিকেটে আগ্রহী ইতালিয়ানরা। এর ৩১ বছর পর ১৮৫১ সালে লন্ডনে প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলার আমন্ত্রণ জানানো হয় ইতালিকে। ক্রিকেটে নতুন হয়েও সে টুর্নামেন্টে অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভালোই লড়েছিল ইতালি, জিতেছিল কিছু ম্যাচও।

সিমোনে গাম্বিনোর বই অনুযায়ী, ইতালিতে ফ্যাসিস্ট শাসনের উত্থানের সঙ্গে কমেছে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা, ফুটবল ধীরে ধীরে সবার মন কেড়ে নেয়। সেখানে ক্রিকেটের পুনর্জন্ম হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দূতাবাসগুলো মিলে সত্তর দশকে ক্রিকেট পুনরায় চালু করে ইতালিতে। ১৯৮০ সালের ২৬ নভেম্বর গাম্বিনোর হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পায় ইতালিয়ান ক্রিকেট ফেডারেশন। ১৯৮৪ সালে আইসিসি দলগুলোর অধিভুক্তি শুরু করলে প্রথম দেশ হিসেবে এই মর্যাদা পায় ইতালি।

মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব ১৯৯৩ সালে ইতালি সফরের দুই বছর পর আইসিসির সহযোগী দেশ হিসেবে অধিভুক্ত হয় ইতালি। গত ২০ বছরে ইতালির ছেলে ও মেয়েদের জাতীয় ক্রিকেট দল ধীরে ধীরে আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে উঠে আসছে। জাতীয় দলে এখনো উপমহাদেশীয় শিকড় ও বংশীয় সূত্রে ইতালির নাগরিকত্ব পাওয়া খেলোয়াড়ের আধিক্যই বেশি। যেমন ধরুন ইতালির বর্তমান অধিনায়ক জো বার্নস। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ২৩ টেস্ট, ৬ ওয়ানডে ও ৮টি টি–টোয়েন্টি খেলা এই ওপেনার গত বছর ইতালির নাগরিকত্ব নিয়ে দেশটির হয়ে খেলা শুরু করেন।

অবশ্য ৩৫ বছর বয়সী বার্নসের ইতালির হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অন্য কারণ ছিল। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে মারা যাওয়া ভাইকে সম্মান জানাতে ইতালির হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বার্নসের মা ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত।

গতকাল টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইতালির খেলা নিশ্চিতের পর বার্নস বলেছেন, ‘এটা আমাদের জন্য অবশ্যই খুব বিশেষ মুহূর্ত। আমরা মানুষকে গর্বিত করার চেষ্টা করছি। ইতালিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার পথে লিগ্যাসি তৈরির চেষ্টা করছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এ দলটা কিছু রেখে যাবে।’

শুধু বার্নস নয়, ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে খেলা এমিলিও গে–ও ইতালি দলের হয়ে খেলেন। নর্দাম্পটনশায়ার ও ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের হয়ে খেলেছেন এই ওপেনার। ইতালিয়ান–অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভুত ব্যাটসম্যান হ্যারি মানেনতি অ্যাডিলেড স্ট্রাইকার্সের হয়ে খেলেছেন বিগ ব্যাশে। তাঁর ভাই বেন মানেনতিও আছেন ইতালি জাতীয় দলে। বেন অ্যাডিলেড স্ট্রাইকার্স ও সিডনি সিক্সার্সে খেলেছেন। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে বেড়ে উঠেছেন দুই ভাই।

ইতালি দলের অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে খেলা জো বার্নস
ইতালি দলের অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে খেলা জো বার্নসআইসিসি

কাউন্টি দল সাসেক্সের দ্বিতীয় একাদশে খেলা ইংরেজ মার্কাস কাম্পোপিয়ানোও আছেন ইতালি দলে। পেসার গ্র্যান্ট স্টুয়ার্ট কাউন্টি দল কেন্টের হয়ে খেলেছেন। আরেক পেসার টমাস ড্রাকা আইপিএলের নিলামে নাম দিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন। পরে তিনি ডাক পান কানাডা ও আরব আমিরাতের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে।

শুধু খেলোয়াড় নয়, ইতালির কোচিং প্যানেলও বেশ সমৃদ্ধ। গত মার্চে ইতালির প্রধান কোচের দায়িত্ব পান কানাডার সাবেক অধিনায়ক ও অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা জন ডেভিসন। তাঁর সহকারীর দায়িত্বে আছেন আয়ারল্যান্ডের কেভিন ও’ব্রায়েন। বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান জাতীয় দলে কাজ করা পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত মহসিন শেখ অ্যানালিস্টের দায়িত্বে আছেন।

inside-post
আরো দেখুন