মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার নারীসহ মাদক সেবনের ছবি ভাইরাল

মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার নারীসহ মাদক সেবনের ছবি ভাইরাল
মাদকের সঙ্গে জড়িত পিরোজপুরের একাধিক ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাদক জব্দ করে তা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. বাবুল সরকার অনেক সময় নিজের কাছে রেখে দেন। পাশাপাশি অর্থের বিনিময়ে নষ্ট করছেন মামলায় ব্যবহার করা যায় এমন আলামতও। তার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষকদের সহযোগিতা করার অভিযোগও রয়েছে।
শুধু বাবুল সরকার নন, তার মতো অনেকেই মাদক সেবন, ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। কারো কারো বিরুদ্ধে এলাকার নিরীহ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে ঘুষ আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। এমন নানাবিধি অভিযোগে গত এক বছরে ২১ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এদের তিনজনকে অব্যাহতি এবং ৪ জনকে লঘুদন্ড দেওয়া হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক (অপারেশনস্ ও গোয়েন্দা) অতিরিক্ত ডিআইজি তানভীর মমতাজের মোবাইল ফোনে ইয়াবা সেবনের স্থিরচিত্র পাঠানো হয়। তিনি এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, ছবিটি কখন, কোথায় তোলা হয়েছিল। সেটি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছি। তিনি আরো বলেন, বাবুল সরকারের বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি যদি সত্যতা পাওয়া যায় তবে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর পিরোজপুর কার্যালয়ের পরিদর্শক বাপন সেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সহকারী পরিচালক স্যার পিরোজপুরের চারতলা ভবনের ডরমেটরিতে একাই থাকেন। তার পরিবার অন্যত্র থাকেন। স্যারের একটা আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটি সত্য কিনা জানি না। তবে মো. বাবুল সরকার স্যার ইয়াবা তো দূরের কথা তিনি ধূমপান পর্যন্ত করেন না। হয়তো একটি পক্ষ স্যারের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছেন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হলেই মূল রহস্য উন্মেচিত হবে বলে বাপন মন্তব্য করেন।
বাবুল সরকারের ইয়াবা সেবনের স্থিরচিত্র অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেখানো হয়েছে। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছবিটি বাবুলের বলে এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন। তারা আরো বলেছেন, ছবির ঘটনাস্থল অধিদপ্তরের চারতলায়। যেখানে সহকারী পরিচালক বাবুল সরকার রাত যাপন করেন। তিনি ২০২৪ সালের ১৫ এপ্রিল পিরোজপুরে সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। সেই থেকে তিনি অধিকাংশ সময় চারতলায় অবস্থান করছেন। সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাতায়াত সীমিত।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর পিরোজপুর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. বাবুল সরকারের আপত্তিকর ভিডিও সোমবার রাতে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মঙ্গলবার কালের কণ্ঠ এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য মোবাইল ফোনে বাবুল সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। একাধিকবার তার সরকারী নম্বরে ফোন দেওয়ার পর কালের কণ্ঠের নম্বরটি ব্লক করেন। এমনকি তার পিরোজপুরের সরকারি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের পাঠিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক পরিতোষ কুমার কুন্ডের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল পৌনে ৪টা পর্যন্ত চেষ্টার পরও তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি তার সরকারি নম্বরের পাশাপাশি ই-মেইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। এই কারণে তাদের দুজনের বক্তব্য দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে পুরো বিষয়টি অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের দুই পরিচালককে জানানো হয়েছে।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও প্রচার কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, কমিটির সদস্য সচিব অতিরিক্ত পরিচালক বাবুল সরকার। তার বিরুদ্ধে সরকারি কার্যালয়ে মাদক সেবনের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি অবগত নন। তবে ঘটনার সত্যতা পেলে তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
মাদক নিয়ন্ত্রণের ২১ কর্মকর্তাকে শাস্তি
গত এক বছরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ২১ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তি ও তিরস্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। অধিদপ্তর বলেন, অনিয়মের রকমফের আছে। এদের মধ্যে ২১ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা শুরু হয়েছে। ১৪টি মামলা চলমান আছে। বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ৪ জনের বিরুদ্ধে। আবার কাউকে তিরস্কার, কাউকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নিজের সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ মাদকে জড়ালে চাকরি থাকবে না বলে জানান অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, এক পরিদর্শকের বিরুদ্ধে আলামত গায়েব করার অভিযোগ রয়েছে। সেখানকার সরকারি কার্যালয়ে বিপুলসংখ্যক ইয়াবা বড়ি ছিল। বরিশালের এক সিপাহীর বিরুদ্ধে এলাকার নিরীহ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে ঘুষ আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। অপর এক পরিদর্শকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা নেন। তার সঙ্গে এক সিপাহীও জড়িত রয়েছেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।
জানতে চাইলে প্রধান কার্যালযের পরিচালক (প্রশাসন, অর্থ ও পরিকল্পনা) মো. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘মাদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের এমন অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে যায়, তখন আমাদের দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। আমরা মাদক কর্মকর্তাদের নজরদারিতে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সে অনুযায়ী অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করছি।
